সম্রাটের জামিন বাতিল নিয়ে দুদকের আইনজীবী: আদালত বিচারককে সতর্ক করেছেন
উত্তরদক্ষিণ । বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ । আপডেট ১২:১৫
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের জামিন বাতিল করেছে হাই কোর্ট। একই সাথে তাকে সাত দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। হাইকোর্টের এই আদেশের বিষয়ে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আদালত বিচারককে সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, জামিন দেওয়ার আগে বিচারকের উচিত ছিল ৯ জুন পর্যন্ত মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট দেখে উনার জামিনের বিষয়টি দেখা। বিস্তারিত লিখেছেন সাদিদ কবির
জামিন বাতিল চেয়ে দুদকের করা এক আবেদেনের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজহারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার (১৮ মে) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের জামিন বাতিল করেছেন। একই সাথে আসামি সম্রাটকে সাত দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। নিম্ন আদালত থেকে জামিন পাওয়া সম্রাট এখন আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান, আর আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী ছিলেন মনসুরুল হক চৌধুরী। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
‘বিচারক ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছে’: সম্রাটের জামিন আদেশ বাতিল চেয়ে হাই কোর্টে গত ১৪মে ‘রিভিউ’ আবেদন করেছিল দুদক। সেই আবেদনের ওপর শুনানি করে বুধবার আদেশের জন্য দিন রাখে আদলত। আদেশের বিষয়ে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, হাই কোর্ট বলেছেন বিচারক মামলার গুণাগুন বিচার না করে, শুধু মেডিকেল গ্রাউন্টে এ জামিন দিয়েছেন। আইনজীবী খুরশীদ আলম পরে গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের যুক্তি ছিল কেউ যদি মেডিকেল গ্রাউন্ডে জামিন চান তাহলে বিচারককে মেডিকেল রিপোর্ট কল করতে হবে, এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করতে হবে, এবং দুইপক্ষকে শুনতে হবে, তারপর জামিন দিবে কিনা আদালত সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু বিচারক ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছে, আদেশে ঠিক এইভাবে অবজার্ভেশন দিয়েছে। খুরশীদ আলম আরও বলেন, বিচারক এই জামিন দিয়েছেন ২০২০ এবং ২০২১ সালের প্রথম দিকের দুইটি মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতে, শেষের দিকে লিখে দিয়েছেন আগামী ৯ তারিখের (৯ জুন) রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। সম্রাটের জামিন প্রসঙ্গে আইনের কোন বিষয়ে ব্যতয় হয়েছে প্রসঙ্গে খুশরীদ আলম বলেন, জামিন দেওয়ার আগে বিচারকের উচিত ছিল ৯ জুন পর্যন্ত মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট দেখে উনার জামিনের বিষয়টি দেখা, তারপর কনসিডার করবেন বা রিজেক্ট করবেন। কিন্তু সেখানে সেই ব্যতয় ঘটেছে।
সাত দিনের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ: এছাড়া অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের ১৩ ধারায় জামিনের কিছু শর্ত রয়েছেন উল্লেখ করে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, সেসব শর্তও উনি পালন করেননি। আদালত বিচারককে সতর্ক করে দিয়েছেন, ভবিষতে যাতে এই ধরনের ভুল না হয়। সম্রাটের আত্মসমর্পণের বিষয়ে দুদক আইনজীবী বলেন, আদালত সম্রাটের জামিন বাতিল করে সাত দিনের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেছে- তাকে জামিনের বিষয়ে মেডিকেল রিপোর্ট যদি কল করার প্রয়োজন হয় তাহলে আইনিভাবে যেন নিষ্পত্তি করা হয়।
ধাপে ধাপে চার মামলায় পেয়েছিলেন জামিন: চলতি বছরের ১০ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১১ মে পর্যন্ত ধাপে ধাপে অস্ত্র, অর্থ চাপার, মাদক ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ মোট চার মামলায় জামিন পেয়ে ৩১ মাস পর মুক্তি মেলে ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের। এতদিন ধরে কারা তত্ত্বাবধায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাধীন ছিলেন সম্রাট। গত ১১ মে’র বিকেলে জামিনের কাগজপত্র হাসপাতালে পৌঁছুলে সেখানেই তার মুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়। মুক্তি পেলেও চিকিৎসার জন্য এখনও তাকে হাসপাতালের ‘ডি’ ব্লকের সিসিইউতে ভর্তি রাখা হয়েছে বলে সেদিনই জানান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আব্দুস সেলিম। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে আত্মগোপনে চলে যান দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত এই নেতা। এরপর ৭ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সেদিন বিকালে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূইয়া ট্রেড সেন্টারে তার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। সেদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযান শেষে গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, ১১৬০টি ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া এবং ‘নির্যাতন করার’ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়ার কথা জানানো হয় র্যাবের পক্ষ থেকে। কার্যালয়ে ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে সম্রাটকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ঢাকার রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে অর্থপাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগেও সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
সম্রাটের বিরুদ্ধে যত মামলা: অস্ত্র মামলা: সম্রাটের বিরুদ্ধে দায়ের করা চার মামলার মধ্যে রমনা থানার অস্ত্র মামলাটিতে ২০১৯ সালে বছর ৬ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এই মামলায় সম্রাটের জামিন হয় চলতি বছরের ১০ এপ্রিল। অর্থ পাচার মামলা: সম্রাটের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা হয় ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। এরপর ৯ ডিসেম্বর মাদক মামলায় সম্রাট ও সহযোগী আরমানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে র্যাব। এই মামলায় সম্রাটের জামিন হয় অস্ত্র মামলার জামিন হওয়ার দিনে, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল। মাদক মামলা: ঢাকার রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১৯ সালে। এই মামলায় সম্রাটের জামিন আসে সবশেষে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা: ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, সম্রাট বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত এই বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকায় ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং সেগুলোতে লোক বসিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন বলেও অভিযোগ আছে। অনেক সময় ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তিনি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ঢাকার গুলশান, ধানমন্ডি ও উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট কিনেছেন এবং বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া তার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে নামে-বেনামে এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য। মামলাটি তদন্ত করে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান ১১ মে অবৈধ সম্পদের মামলাতেও সম্রাটের জামিন মঞ্জুর করেন। আর তাতেই তার মুক্তির বাধা কাটে। তবে চার মামলাতেই জামিন আসার পরিক্রমার এক মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই দুই মামলায় (অর্থ পাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের) মামলায় সম্রাটের জামিন বাতিল করে তাকে বিচারিক আদালতের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিল হাই কোর্ট।
সম্রাটকে হাসপাতালেই রাখার পক্ষে ছিলেন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ: কারাগার থেকে জামিন পেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি বিবেচনায় যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটকে হাসাপাতালেই রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ। তবে জামিন বিবেচনায় পরিবার চাইলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্য হাসপাতালে বা বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে বলে জানিয়েছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এতদিন উনার চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা জেল অথোরিটিকে অভিভাবক ভেবেছি। এখন যেহেতু উনি মুক্ত, আজকে থেকে চিকিৎসার বিষয়ে উনার অভিভাবকদের জানাব। এখন তার অভিভাবক বিবেচনা করবে, কোথায় তাকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। দেশে নাকি বিদেশে নেবে। মেডিকেলের কার্ডিয়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান মাসুম মণ্ডল সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, সম্রাট ‘হার্টের ক্রনিক অসুখে’ ভুগছেন। এটা কিছু সময় স্টেবল থাকে, কিছু সময় আনস্টেবল হয়ে যায়। উনার হার্টে যে অসুখগুলো আছে, তার তিন চারটা ডায়াগনোসিস এমন যে, হঠাৎ করে মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে।এই চিকিৎসক আরও জানিয়েছিয়েন, এতদিন মনিটর করার পর গত তিন সপ্তাহ ধরে উনার কন্ডিশন স্থিতিশীল আছে। আগামী সোমবারের দিকে আমরা আবার টোটাল রিভিউ করব। বেটার কোনো চিকিৎসা আছে কিনা, সেটা নিয়ে আমরা উনার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলব। উনার অভিভাবকরাই সিদ্ধান্ত নেবে কোথায় চিকিৎসা নেবেন।
ইউডি/সুপ্ত