ইউরোপ আমেরিকা কানাডায় নতুন আতংক: মাংকিপক্স ভাইরাস

ইউরোপ আমেরিকা কানাডায় নতুন আতংক: মাংকিপক্স ভাইরাস

উত্তরদক্ষিণ । শনিবার, ২১ মে ২০২২ । আপডেট ১২:০৫

আমেরিকা, কানাডা, স্পেন, পর্তুগাল এবং ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়েছে এক বিরল রোগ। বিরল রোগটির নাম মাংকিপক্স। আফ্রিকা থেকে ছড়ায় রোগটি। করোনা মহামারি শেষ হওয়ার আগেই ইউরোপ ও আমেরিকায় দেখা দিচ্ছে এ বিরল রোগ। এখন পর্যন্ত মাংকিপক্স নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই, তবুও সচেনতা জরুরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মত মহামারি হবে না এতে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সাইফুল অনিক।

ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশসহ আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে মাংকিপক্সে আক্রান্তদের খোঁজা হচ্ছে বলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। এই রোগে সর্বশেষ নতুন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ফ্রান্স, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ায়। বুধবার আমেরিকা, স্পেন ও পর্তুগাল মাংকিপক্সে আক্রান্ত শনাক্তের ঘোষণা পর এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কানাডাও রোগটিতে আক্রান্ত সন্দেহে ১৩ জনকে পর্যালোচনা করছে। বৃটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) জানায়, বৃটেনে প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৭ মে। ওই রোগী সম্প্রতি নাইজেরিয়া সফর করেছেন। ধারণা হয় সেখানে তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ইংল্যান্ডে ফিরেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, এখন পর্যন্ত বৃটেনে ৯ আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সংক্রমণের উৎস সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কয়েকজন ‘স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত’ হতে পারে।

করোনার মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। চলছে ভ্যাকসিন কার্যক্রম। এরমধ্যেই শঙ্কা জাগিয়েছে বিরল রোগ মাংকিপক্স। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে দেখা দিয়েছে এর প্রাদুর্ভাব। মেসাচুসেট জেনারেল হাসপাতালের সেন্টার ফর ডিজেস্টার মেডিসিন বিভাগের পরিচালক ড. পল বিডিঞ্জার এই রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে বলেন, মাংকিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বর্তমানে তার অবস্থা স্থিতিশীল। রোগটি যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কীভাবে তিনি আক্রান্ত হলে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

এদিকে, বৃটেনে আক্রান্তের সরিলে পশ্চিম আফ্রিকা ধরন শনাক্ত হয়নি। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক জিমি হোয়াইটওয়ার্থ বলেন—ঐতিহাসিকভাবে, এখন পর্যন্ত খুবই কম রোগী আক্রান্ত হওয়ার পর এখানে (ব্রিটেন) এসেছেন। চলতি বছরের আগে মাত্র আটটি এমন ঘটনা আছে। যা আসলে অতি অস্বাভাবিক ঘটনা।

ভ্রমণ বাড়ায় সংক্রমণ বাড়ছে
ব্রিটিশ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সম্প্রতি যারা মাংকিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা স্বঘোষিত সমকামী ও উভকামী। ভাইরাসটির সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক আছে কিনা; তা বের করতে বর্তমানে জিনোম সিকোয়েন্সিং করছেন বিজ্ঞানীরা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আরোপ করা বিধিনিষেধ উঠিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। এতে মানুষের ভ্রমণও বাড়ছে। যে কারণে এ সময়ে এসে মাংকিপক্সের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এমন একটি শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় প্রচুর মাংকিপক্স রোগী। করোনাপরবর্তী ভ্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে এই বিরল রোগটির সংক্রমণ বেড়েছে।

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ডব্লিউএইচও
এবার মাংকিপক্স নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডব্লিউএইচওর বৈঠকে মাংকিপক্সের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং এর ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

এদিকে, পর্তুগালের স্বাস্থ্যবিদ মার্গারিদা ত্যাভেরেস বলেন, পর্তুগালে কেউ হাসপাতালে ভর্তি নন; এছাড়া অবস্থাও গুরুতর নয়। জ্বর, ক্লান্তি, মাংসপেশী ও মাথাব্যথার মতো প্রাথমিক উপসর্গ ছিল। পরে দেখা যায় ফুঁসকুড়ি।

গবেষকদের দাবি, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বা আফ্রিকান ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায় রোগটি। তারপরই, কোনোভাবে প্রবেশ করে মানবশরীরে। কিন্তু রোগ বিস্তারের জন্য এটা নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়। কারণ, খুব বেশি মানুষ তাতে আক্রান্ত হন না। তাছাড়া, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে সেটির নির্মূল সম্ভব। আফ্রিকার বাইরে যেহেতু প্রথমবার বিস্তারলাভ করছে, তাই সতর্ক থাকা ভালো।

What is monkeypox: মাংকিপক্স কী? কেন এই অসুখটি নিয়ে এত ভয়? কীভাবে এটি  থেকে বাঁচবেন - What is monkeypox and how it spreads; know symptoms from  expert, Bangla News Lifestyle News, Lifestyle
মাংকিপক্সে আক্রান্ত রোগীর হাত

মাংকিপক্স নিয়ে উদ্বেগ নেই
মাংকিপক্স এক ধরণের ভাইরাল ইনফেকশন, যে ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকা ও মধ্য আফ্রিকার জঙ্গলের ছোট আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর মধ্যে থাকে। এর বৈশিষ্ট্য জল বসন্তের মতই, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক হারে ছড়িয়ে না পড়লে এই ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ বিভাগের কর্মকর্তা ড. নিক ফিন বলছেন, এটা বুঝতে হবে যে মাংকিপক্সের ভাইরাস খুব সহজে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে না। সে কারণেই এখন পর্যন্ত মাংকিপক্স নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সতর্ক পদক্ষেপে প্রকোপ রোধ সম্ভব
গুটিবসন্তের পরিবারের রোগটি নিয়ে ভাইরাসবিদরা সতর্ক করে দিয়েছেন। যদিও এতে অসুস্থতা মারাত্মক কিছু না। ভাইরাসটির কোনো চিকিৎসাও আবিষ্কার হয়নি। সতর্ক পদক্ষেপ নিলে প্রকোপ রোধ করা সম্ভব। ক্যালিফোর্নিয়ার ইউসিএলএ’র মহামারিবিদ্যার অধ্যাপক অ্যান্নে রিমোইন বলেন, ১৯৮০ সালে গুটিবসন্ত নির্মূল করা হয়েছে। এরপর থেকে রোগটির টিকা ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু গুটিবসন্তের টিকা দিয়ে মাংকিপক্স থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু গুটিবসন্তের টিকা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মাংকিপক্সের সংক্রমণ বেড়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি রোগটি কেন ছড়িয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। ভাইরাসটিতে পরিবর্তন কিংবা রূপান্তর ঘটতে পারে। এমন কিছু ঘটলে তাও নির্ধারণ করতে হবে।

মাংকিপক্স ও বাংলাদেশ
আমাদের উপমাহদেশে এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত কোন রোগী পাওয়া যায় নি। সেদিক থেকে এখন পর্যন্ত নিরাপদ বাংলাদেশ। যদিও মানুষের মাঝে এ রোগ ছড়ানোর হার খুবই কম, তবুও বৈশ্বিক ভাবে ইউরোপ আমেরিকা ও আফ্রিকায় যাতায়তের কথা মাথায় রেখে আমাদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যদি কখনো হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিমান বন্দরে এই রোগের উপসর্গ চিহ্নিত করার জন্য মেডিক্যাল টিম বসানো যেতে পারে।

ইউরোপ আমেরিকা কানাডায় ছড়াচ্ছে মাংকিপক্স - Beanibazar View24
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার বিমানবন্দরে মাংকিপক্সে আক্রান্ত কিনা শনাক্ত হচ্ছে

মাংকিপক্স ও এর উপসর্গ
এই রোগ ছড়ায় মাংকিপক্স নামে এক ধরনের ভাইরাসের মাধ্যমে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটি অনেকটা জল বসন্তের ভাইরাসের মতো। তবে এর ক্ষতিকারক প্রভাব কম, এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সংক্রমণের হারও কম। পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার নিরক্ষীয় বনাঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। মাংকিপক্স দু’ধরনের হয়ে থাকে – মধ্য আফ্রিকান এবং পশ্চিম আফ্রিকান। ব্রিটেনে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন যে দু’ব্যক্তি এরা সম্প্রতি নাইজেরিয়া সফর করেছেন। এরা সম্ভবত পশ্চিম আফ্রিকা ধরনের মাংকিপক্সে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তৃতীয় যে ব্যক্তি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি রোগীদের কাছ থেকে এই ভাইরাস পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, হাড়ের জয়েন্ট এবং মাংসপেশিতে ব্যথা এবং দেহে অবসাদ। জ্বর শুরু হওয়ার পর দেহে গুটি দেখা দেয়। এসব গুটি শুরুতে দেখা দেয় মুখে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে হাত এবং পায়ের পাতাসহ দেহের সব জায়গায়। এই গুটির জন্য রোগী দেহে খুব চুলকানি হয়। পরে গুটি থেকে ক্ষত দেখা দেয়। গুটি বসন্তের মতোই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও দেহে এসব ক্ষত চিহ্ন রয়ে যায়।

যেভাবে ছড়ায় মাংকিপক্স
সংক্রমিত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের ক্ষত থেকে এবং নাক, মুখ ও চোখের ভেতর দিয়ে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এমনকি মাংকিপক্সে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানাপত্র থেকেও এই ভাইরাস অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের প্রভাব বেশ মৃদু। এর বৈশিষ্ট্য জল বসন্তের মতোই, এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

দৈনিক উত্তরদক্ষিণ । ২১ মে ২০২২ । ১ম পৃষ্ঠা

মাংকিপক্সের চিকিৎসা
এই ভাইরাসের কোন চিকিৎসা নেই। তবে যে কোন প্রাদুর্ভাবের মতোই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রকোপ রোধ করা যায়। গুটি বসন্তের টিকা ৮৫% কার্যকর বলে দেখা গেছে। মাংকিপক্সের জন্য এখন এই টিকাই ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই রোগের উৎপত্তি
এই রোগ প্রথম ছড়িয়েছিল একটি বানর থেকে। এরপর ১৯৭০ সাল থেকে আফ্রিকার ১০টি দেশে মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আমেরিকায় প্রথম এই ভাইরাসে রোগী শনাক্ত হয় ২০০৩ সালে। সেটাই ছিল এই ভাইরাস আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম কেস। আমেরিকায় এপর্যন্ত ৮১টি কেস ধরা পড়েছে। মাংকিপক্সের সবচেয়ে বড় প্রকোপ দেখা দেয় নাইজেরিয়াতে, ২০১৭ সালে। সে দেশে মাংকিপক্সের প্রথম কেস ধরা পড়ার ৪০ বছর পর। এতে ১৭২ জন আক্রান্ত হন।

লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার মতো মাংকিপক্স মহাকারি আকারে দেশজুড়ে ছড়াবে না। তবে এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত বলে মত দিচ্ছেন ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা।

ইউডি/অনিক

melongazi

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading