বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ধাক্কা, বদলে গেছে ‘শাদী’!

বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ধাক্কা, বদলে গেছে ‘শাদী’!

উত্তরদক্ষিণ । বৃহস্পতিবার ২৫ জুন ২০২০ । আপডেট ১৮:০০

আমেরিকায় কৃষাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদে বর্ণবাদ বিরোধী যে আন্দোলন বিশ্বজুড়ে চলছে, তার ধাক্কা লেগেছে দক্ষিণ এশিয়দের বিয়ের ঘটকালির সাইট শাদী-ডট-কমেও। বিবাহ-শাদীর ঘটকালির জন্য এই ওয়েবসাইটটিতে গায়ের রং ফর্স দেখানোর জন্য এতদিন একটি ফিল্টার ব্যবহার করা হত। ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীদের চাপের মুখে ছবিতে গায়ের রং পরিবর্তন করার ওই ফিল্টার তাদের সাইট থেকে তুলে নিয়েছে। আমেরিকার ডালাসের হেতাল লাখানি ওই ফিল্টারের বিরুদ্ধে অনলাইনে একটা পিটিশান শুরু করেন, যার ফলে চাপের মুখে সাইটটি ওই ফিল্টারের ব্যবহার সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। খবর বিবিসি’র।

সাইট ব্যবহারকারী আরেকজন নারী, বিশ্বজুড়ে চলমান বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদের আলোকে ওই ফিল্টার ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর এই প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন হেতাল লাখানি।

শাদী-ডট-কম যুক্তি দিয়েছে বলেছে, ওই ফিল্টার “আসলে কোনও কাজে লাগানো হচ্ছিল না। এটা পুরোনো একটা আবর্জনা, যা সরিয়ে ফেলতে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম”।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন শাদী-ডট-কমে নতুন কোনও গ্রাহক তার ছবি আপলোড করেন, তখন তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, তারা তাদের গায়ের রং কতটা উজ্জ্বল বা কালো দেখাতে চান। সাইটে “স্কিন টোন” বা “গায়ের রং” পছন্দ করার আলাদা ব্যবস্থা আছে। ব্যবহারকারীদের তাদের পছন্দ করা গায়ের রং অনুযায়ী জীবন সঙ্গী খুঁজে বের করার ব্যবস্থাও সাইটে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শাদী-ডট-কম এখন দাবি করছে- ওই ফিল্টার কাজ করছিল না এবং যারা জীবনসঙ্গী খুঁজছে তারা যে কোন গায়ের রং-এর সকলের ছবিই সেখানে দেখতে পাচ্ছিলেন।

জীবনসঙ্গী খোঁজার অন্য সাইটগুলোর থেকে শাদী-ডট-কম আলাদা। কারণ, দক্ষিণ এশিয়দের প্রথাগত ঘটক ব্যবস্থার এটি একটি বিকল্প এবং দক্ষিণ এশিয়দের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে এই সাইট বেশ জনপ্রিয়।

শাদী ডট কম-এর রং ফর্সার ফিল্টারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মেঘান ও হেতাল। ছবি: বিবিসি’র সৌজন্যে।

মেঘান নাগপাল ওই ওয়েবসাইট ব্যবহার করছিলেন একজন জীবনসঙ্গী খোঁজার জন্য। তিনি খুঁজছিলেন একজন ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত জীবনসাথী। তিনি বলেন, “আমি ওদের (শাদী-ডট-কম-এর) কাছে ইমেল পাঠিয়েছিলাম। তাদের একজন প্রতিনিধি বলেছিল, বেশিরভাগ বাবা-মা এই ফিল্টারটা চান,” বিবিসির এশিয়ান নেটওয়ার্ককে বলেন মেঘান। এরপর তিনি ফেসবুকে এই গায়ের রং বদলানোর ফিল্টার নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ফেসবুকের ওই পাতার সদস্য ছিলেন আমেরিকার বাসিন্দা হেতাল লাখানি।

‘আমি সত্যিই স্তম্ভিত হয়েছিলাম’
“মেঘান যখন আমাদের গ্রুপে এটা শেয়ার করল, আমি সত্যিই স্তম্ভিত হয়েছিলাম কারণ যে কোন প্রতিষ্ঠানের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে,” বলেন হেতাল। “আমি এই সমস্যা এমনভাবে সমাধান করতে চেয়েছিলাম, যাতে একটা পরিবর্তন আনা যায়। কাজেই অনলাইনে প্রতিবাদ শুরু করলাম। আর তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ১৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা দেড় হাজার সই পেলাম। আমরা বিষয়টা সামনে আনায় যারা সই করছিল তারা খুবই খুশি হয়েছিল।”

রোশনি নামে একজন ব্লগার ওই অনলাইন প্রতিবাদের বিষয়টি শাদী-ডট-কমের সাথে শেয়ার করেন। তিনি আরবান-এশিয়ান নামে একটি বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট চালান। তিনি শাদী-ডট-কম সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন, তারা যেন মেঘানের ক্ষোভের উত্তর দেয়। তিনি ছবিতে গায়ের রং বদলে দেবার ওই ফিল্টারকে “অসম্মানজনক ” এবং “জঘন্য” বলে বর্ণনা করেন।

শাদী-ডট-কম জানায়, ওই ফিল্টারটা ছিল একটা “ব্লাইন্ডস্পট”। সাইটে এটা এমনভাবে “চোখের আড়ালে” ছিল যে তাদের এটা চোখেই পড়েনি। তারা এরপর রাতারাতি ফিল্টারটি সরিয়ে নেয়। “বিশ্বের সর্বত্র দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে সবাইকে সমান চোখে দেখার বিষয়টা প্রতিষ্ঠা করার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা ছোট একটা পদক্ষেপ মাত্র,” মেঘান বলছেন।

হেতাল আরও বলছেন: “আমি ব্যাচেলারস ডিগ্রি, মাস্টারর্স ডিগ্রি করেছি। আমার গায়ের রং যদি তার থেকেও বড় বিষয় হয়- তাহলে তার থেকে খারাপ আর কী হতে পারে?”

দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ণবৈষম্য
আফ্রিকান আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বর্ণবাদ বিরোধী যে প্রতিবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ণ নিয়ে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিটি সামনে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের মধ্যে ফর্সা রঙের মানুষদের ব্যাপারে একটা অবচেতন পক্ষপাতিত্ব আছে।

ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকারাও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। “বলিউড তারকারা একদিকে ফর্সা হবার ক্রিমের বিজ্ঞাপন সমর্থন করছেন। অন্যদিকে তারাই আবার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনেও গলা মেলাচ্ছেন,” বলছেন মেঘান। তিনি বলেন, “কাজেই আমার তো মনে হয়, দক্ষিণ এশিয় সংস্কৃতিতে একটা বদ্ধমূল মানসিকতা আছে যে, ফর্সা রং ভালো আর সেটাই আমরা দেখছি বিয়ের ঘটকালির ওই সব ওয়েবসাইটে।”

শাদী-ডট-কমের মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক বিবিসি এশিয়ান নেটওয়ার্ককে বলেছেন, “আমরা প্রকৃত অর্থেই বিশ্বাস করি, যেকোনও বর্ণের যেকোনও ধরনের মানুষের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা হতে পারে। আমরা ইন্ডিয়ার সব শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি এবং সেজন্য আমরা গর্বিত।”