শ্রীলঙ্কার অনিশ্চিত যাত্রা

শ্রীলঙ্কার অনিশ্চিত যাত্রা
উত্তরদক্ষিণ । ১৩ জুলাই ২০২২

উত্তরদক্ষিণ । বুধবার, ১৩ জুলাই ২০২২ । আপডেট ১২:০৫

শ্রীলঙ্কায় কী হচ্ছে, কী হবে আর কোন পথে যাচ্ছে সবকিছু নিয়েই আলোচনা তুঙ্গে। বিপর্যস্ত অর্থনীতি আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্য দিয়েই আগামী ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এছাড়াও ক্ষমতা ছাড়ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও। সেক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন আর তারাই বা দেশটির বিপর্যয় কিভাবে মোকাবেলা করবেন তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। এশিয়ার দুই জায়ান্ট চীন ও ইন্ডিয়ার ভূমিকা নিয়েও আলোচনা চলছে। বিস্তারিত লিখেছেন মো. রুবেল

গোতাবায়া রাজাপাকসে গত সোমবার (১১ জুলাই) তার পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে এরই মধ্যে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছেন। যদিও যে পদত্যাগপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছেন তার তারিখ দেয়া আছে বুধবার (১৩ জুলাই)। এরই মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবিবর্ধনে। তিনি আজ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়টি জনসমক্ষে জানাবেন। শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হাজারো মানুষ গত মার্চ মাস থেকে রাজপথে বিক্ষোভ করছেন। দেশটিতে নগদ অর্থ ফুরিয়ে গেছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। জ্বালানির ভয়াবহ ঘাটতির ফলে গণপরিবহনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। এতে বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হচ্ছে মানুষদের। জ্বালানি সংকটে এই সপ্তাহে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক মানুষ দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। জুন মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৫৫ শতাংশতে পৌঁছেছে এবং লাখো মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচতে সংকটে রয়েছে। পার্লামেন্টের স্পিকার আইনপ্রণেতাদের বলেছেন আগামী ২০ জুলাই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্য।

গণবিক্ষোভে বিজয়, এরপর কী? : শ্রীলঙ্কার জনগন তাদের অধিকার ফিরে পেতে নতুন ইতিহাস তৈরি করলো। দেশের প্রেসিডেন্টকে তার বিলাসবহুল প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন আগুনে পুড়িয়ে তাদের কাছ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা আদায় করে গণবিক্ষোভের প্রাথমিক বিজয় যে ছিনিয়ে এনেছেন তাতে বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ নেই। কিন্তু এতেই কি সমাধান হবে? শ্রীলঙ্কা কি দ্রুতই অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ লাভ করতে পারবে? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার এখন প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য, ডলার, জ্বালানি এবং খাদ্য। কে দেবে দেশটিকে উদার হাতে বিপুল সহায়তা?

চীন নাকি ইউরোপ-আমেরিকা?: বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গোটা বিশে^র অর্থনৈতিক অবস্থান নাজুক। সেখানে লঙ্কাকে কোন দেশ এই ধ্বংস হওয়া অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে? শুরুতেই ধরা যাক চীনের কথা। তারা তো দেশটিকে যে ঋণ দিয়েছে সেটা নিয়েই সংশয়ে আছে। উপরিউন্তু তারা কি এগিয়ে আসবে? বিশ্লেষকরা বলছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া এই মুহূর্তে আর্থিকভাবে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়াবে না। তারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাই এখন শ্রীলঙ্কার হাত পাতার উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত পেলে আইএমএফ এবার তার প্যাকেজ নিয়ে হাজির হতে পারে।

তারুণ্য চাইছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

তারুণ্য চাইছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা থেকে জানা যাচ্ছে, গোতাবায়ার স্থলে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রধান বিরোধী দল ‘সঙ্গী জন বালাওয়েগা’র সজিথ প্রেমাদাসা, সাবেক সেনাপ্রধান শরৎ ফনসেকা এবং জেভিপির অনুঢ়া কুমার দেশনায়েকে আসতে পারেন। তবে এদের বাইরেও কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। পার্লামেন্টের স্পিকারের নামও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও লাগবে কাউকে। তবে সব ক্ষেত্রে জেভিপি ও সঙ্গী জন বালাওয়েগার সমর্থন লাগবে। কারণ, জনতার কাছে এখন কেবল এই দুই রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাব রয়েছে। তবে নতুন সরকারের জন্য এর চেয়েও জরুরি হলো সেই ছাত্র-তরুণদের সম্মতি, যারা গত পাঁচ মাস রাজপথে পড়ে ছিল রাজাপাকসেদের তাড়াতে। নতুন সরকারকে তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতেই হবে। না হলে তারা আবার রাস্তায় নামবে। এই তারুণ্য চাইছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ। তারা রাজাপাকসেদের পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে রেখেছে। সর্বোপরি তারা দেশটির এত দিনকার চমক দেখানো উন্নয়ন-রাজনীতির বদলও চাইছে। এর মধ্যে প্রথমটা যে অর্জিত হবে, সেটা নিশ্চিত। এতে শ্রীলঙ্কার সমাজে তামিলদের কথা বলার রাজনৈতিক পরিসর খানিকটা বাড়বে। সিংহলি সমাজেও গণতান্ত্রিক আবহ বাড়তি জোর পাবে।

দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে ইন্ডিয়া: কলম্বোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দিল্লিও দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে, তারা এখনই কোনও কমিটমেন্টে যেতে চায় না। ইন্ডিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও শ্রীলঙ্কায় দেশটির প্রাক্তন হাই কমিশনার নিরুপমা মেনন রাও গণমাধ্যমকে বলেছেন, আজকের শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাটাই দস্তুর। দেশটা কোন পথে যাবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তের ঐকমত্য নেই। কী ধরনের সর্বদলীয় সরকার হতে পারে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না – অথচ আইএমএফ বেইল আউটের প্রধান শর্ত ওটাই। আর ইন্ডিয়ার মুশকিলটা হল, শ্রীলঙ্কায় যা ঘটে তা শুধু সেখানেই আটকে থাকে না, তার ধাক্কা আমাদের ওপরেও এসে পড়ে। তিনি বলেন, ইন্ডিয়ায় শ্রীলঙ্কাতে দারিদ্রসীমার আশেপাশে থাকে মানুষজনের জন্য কোনও আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ দেওয়ার কথা। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বা ওই জাতীয় সংগঠনের মাধ্যমেই সেটা করতে হবে বলে জানান নিরুপমা রাও মেনন।

‘নাক গলাতে গেলে ভুল করবে ইন্ডিয়া’: কলম্বোর রাজনৈতিক গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে বা কারা আগামী দিনে দেশের কর্তৃত্ব নিতে পারে, তা নিয়ে এই মুহুর্তে ইন্ডিয়ার ধারণা যে খুব স্বচ্ছ নয় সেটা অবশ্য পরিষ্কার। দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ও শ্রীলঙ্কা পর্যবেক্ষক সুরেশ কে গোয়েলের মতে, ইন্ডিয়া সেটা আন্দাজ করারও কোনও দরকার নেই – বরং শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে গেলে ইন্ডিয়া বিরাট ভুল করবে। মি গোয়েল বলেন, সেখানকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে ইন্ডিয়া পুরোপুরি দূরে থাকা উচিত – নইলে কিন্তু ইন্ডিয়াও চীনের মতো একই ধরনের বিপদে পড়বে। চীন এক সময় শ্রীলঙ্কাতে খুব অ্যাক্টিভ ইন্টারেস্ট দেখিয়েছিল, এখনও হামবানটাটো বন্দরের পরিচালনার রাশ তাদেরই হাতে – কিন্তু বর্তমান সঙ্কটে তারা কোনও সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না বললেই চলে, বরং খুব সাবধানে পা ফেলছে।

বাসিল রাজপাকসে

দেশ ছাড়ার ব্যর্থ চেষ্টা গোতাবায়ার: শ্রীলঙ্কার পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে মঙ্গলবার (১২ জুলাই) সকালে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির ইমগ্রেশন অফিসারদের বাধায় তিনি যেতে পারেননি। আকাশপথে ব্যর্থ হয়ে তিনি নৌবাহিনীর জাহাজে শ্রীলঙ্কা ছাড়ার চেষ্টা করেন। খবর আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৪ বছর বয়সী গোতাবায়া রাজপাকসে স্ত্রীসহ দেশটির কলম্বোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে সামরিক ঘাঁটিতে ছিলেন। তিনি গত সোমবার রাতে সেখানেই ছিলেন। সেখান থেকেই মঙ্গলবার সকালে তিনি বিমানবন্দরে আসেন। গোতাবায়া বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে ভিআইপি স্যুটে অপেক্ষা করছিলেন। নিরাপত্তার জন্যই তাকে সেখানে রাখা হয়। এরপর তার পাসপোর্ট সিল মারার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসারদের ভিআইপি স্যুটে যেতে বলা হয়। তারা গোতাবায়ার পাসপোর্টে সিল মারতে অস্বীকার করেন।গোতাবায়া পরিবার নিয়ে সম্ভবত দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গোতাবায়ার ছোট ভাই ও দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজপাকসেও গোপনে দেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বাধার কারণে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এদিন সকালে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে গোপনে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে হাজির হন বাসিল। কিন্তু বিমানবন্দরে থাকা লোকজন তাকে চিনে ফেলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দর ঘেরাও করে অবস্থান নেন। এ পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাসিলকে ভ্রমণজনিত ক্লিয়ারেন্স দিতে রাজি না হওয়ায় ফিরে যান শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী।

সাজিথ প্রেমাদাসা

প্রেসিডেন্ট হতে চান বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ: গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দলের নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে তিনি একথা জানিয়েছেন। তার দল সামাজি জন বালাবেগায়ার (এসজিবি) পক্ষ থেকে মিত্রদের সমর্থন আদায় নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন তিনি এই ইচ্ছার কথা জানালেন। প্রেমাদাসা বলেছেন, তার দল ও মিত্ররা একমত হয়েছে যে যদি শূন্যতা দেখা দেয় তাহলে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে।২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রেমাদাসা হেরেছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট হতে হলে তাকে ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের সমর্থন পেতে হবে। রাজাপাকসে ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে গণরোষের ওপর ভরসা রাখছেন তিনি। দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাজপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছে।প্রেমাদাসা বলেছেন, তিনি সর্বদলীয় অন্তর্র্বতী সরকারে যোগ দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘দ্বিধা, অনিশ্চিয়তা ও সর্বাত্মক নৈরাজ্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন প্রেমাদাসা। বলছেন, দেশটির প্রয়োজন ‘ঐকমত্য, পরামর্শ, সমঝোতা এবং ঐক্যবদ্ধতা’। প্রেমাদাসা স্বীকার করছেন, এই সংকটের দ্রুত কোনও সমাধান নেই। তার মতে, ২০১৯ সালের আগের অবস্থায় অর্থনীতিকে নিয়ে আসতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমরা জনগণকে প্রতারিত করব না। আমরা অকপট হব এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘবের একটি পরিকল্পনা তুলে ধরব।

উত্তরদক্ষিণ । ১৩ জুলাই ২০২২ । ১ম পৃষ্ঠা

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ: শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আহতদের কলম্বো ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২ জনকে চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গত ৯ জুলাই সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর ভবনে হামলা চালানোর পর এটি দখল করে নেয়। সেদিন কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

ইউডি/সুপ্ত

Md Enamul

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading