চায়নার হুমকির মুখে পেলোসির চ্যালেঞ্জ

চায়নার হুমকির মুখে পেলোসির চ্যালেঞ্জ
উত্তরদক্ষিণ । ০৩ আগস্ট ২০২২

উত্তরদক্ষিণ । বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২ । আপডেট ১২:১০

সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার আইরন ল্যাডি খ্যাত ন্যান্সি পেলোসি। চীনের লাগাতর হুমকির মুখেও মঙ্গলবার (২ আগস্ট) স্থানীয় সময় রাত পৌনে ১১টায় তাইওয়ানে পৌঁছান তিনি। তার এই সফর ঘিরে ইতোমধ্যেই নিজেদের আগ্রাসন দেখাতে শুরু করেছে চীন। তাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান আনাগোনা শুরু করেছে তাইওয়ান উপত্যকায়। অন্যদিকে, আমেরিকারও চারটি রণতরী তাইওয়ানের কাছাকাছি অবস্থান করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এমনিতেই বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। আর চীন-আমেরিকার নতুন এই দ্বৈরথ কী বার্তা দিচ্ছে? বিস্তারিত লিখেছেন আসাদ এফ রহমান

গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর। এই সফর কী আসলেই হবে নাকি শেষতক সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন তিনি এই নিয়েই ছিল ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে মঙ্গলবার ন্যান্সি পেলোসির সেই তাইওয়ান সফর হলোই। আর এই সফর ঘিরে তাইওয়ান প্রণালীতে যেন যুদ্ধের আবহই বিরাজ করছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৩০) পেলোসির তাইওয়ানে অবতরণকে কেন্দ্র করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, তাইওয়ান প্রণালী অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াতে আমেরিকা ইচ্ছাকৃতভাবে এই উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব দেশটিকে নিতে হবে। পাশাপাশি, চীনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাগত স্বার্থকে অবমূল্যায়নের জন্য মূল্যও পরিশোধ করতে হবে আমেরিকাকে। পেলোসির তাইওয়ান সফরকে শুরু থেকেই সাপোর্ট করছিলেন না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার প্রশাসন। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে চলমান এশিয়া সফরে তাইওয়ান যাওয়ার পণই বোধহয় করেছিলেন পেলোসি। তাইতো সকল বাধা অতিক্রম করে তাইওয়ানের মাটিতে যে পা রাখলেনই। তার এই সফর ঘিরে শুরু থেকেই আমেরিকাকে এক হাত নিয়েছে চীন। এর প্রতিউত্তরে আমেরিকাী চীনের ‘সামরিক হুমকিকে’ ভয় পাবে না বলে জানান দিয়েছিলো। চীন থেকে বারবার না বলা সত্ত্বেও পেলোসির এই তাইওয়ান সফর শুধু সামরিক হুমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চীন-আমেরিকার মধ্যে রাজনৈতিকভাবেও অস্থিরতা শুরু হবে।

বিপজ্জনক ও উস্কানিমূলক এক সফর: পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আমেরিকাকে আগেও সতর্ক করেছে চীন। কিন্তু এবার প্রকাশ্যে সেটা জানান দিলো তারা। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের প্রতিনিধি ঝাং জুন বলেছেন, পেলোসির তাইওয়ান সফর আমেরিকার সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঝাং জুন বলেন, এই ধরনের একটি সফর দৃশ্যত অত্যন্ত বিপজ্জনক, খুবই উস্কানিমূলক। যদি এমন একটি সফর ঘটে তবে এটি চীন ও আমেরিকার সম্পর্ককেও ক্ষুন্ন করবে। কিছু বহিরাগত শক্তির সমর্থনে তাইওয়ানের পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ঝাং জুন আরও বলেন, স্বাধীনতার প্রতি তাইওয়ানের ঝোঁক আরও বাড়ছে। যদি আমরা এটি বন্ধে যথাযথ ও জোরালো পদক্ষেপ না নেই তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ঝাং জুন জোর দিয়ে বলেন, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখøতা রক্ষার জন্য বেইজিং তার পক্ষে সম্ভব সবকিছু করবে।

জো বাইডেন

বাইডেন প্রশাসনেও উদ্বেগ : ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে পশ্চিমা অর্থনীতির যে বেহাল দশা এখন চলছে – সেসময় স্পিকার পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে চীনের সাথে সম্ভাব্য একটি সংঘাতের ঝুঁকি কি আমেরিকা নেবে? প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য বিষয়টি উদ্বেগের। তিনি যেখানে বারবার তাইওয়ানকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন- তখনই আবার চীনের চাপে স্পিকার পেলোসিকে থামালে তাকে নিশ্চিতভাবে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। তবে আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যে বিতর্কিত এই সফর নিয়ে দোটানা স্পষ্ট। বাইডেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন সেনা কম্যান্ডাররা মনে করছেন এই মুহুর্তে স্পিকার পেলোসির তাইওয়ান সফর ইতিবাচক হবে না। আমেরিকার মিডিয়াগুলো বলছে হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগনের পক্ষ থেকে স্পিকারের অফিসের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে তিনি যেন এখন এই সফর স্থগিত করেন। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বলচে, পেলোসির সফর নিয়ে মুখে উল্লাস প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে তাইওয়ানের সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার নীতি ঠিক কী – তা নিয়ে তাইওয়ানের মধ্যে এখনও অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে।

আগুন নিয়ে খেললে ধ্বংস অনিবার্য: সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক ফোনালাপে পেলোসির এই সফরকে কেন্দ্র করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, আগুন নিয়ে যারা খেলা করে, সেই আগুনে তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। শি বলেছিলেন, চীন দৃঢ়ভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতা এবং এ অঞ্চলে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে। আমেরিকার উচিত ‘এক চীন নীতি’ মেনে চলা। বেইজিং জানিয়েছে, পেলোসি সফরের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে ওয়াশিংটনকে ‘মারাত্মক পরিণতি’র মুখে পড়তে হবে। এ নিয়ে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। অপরদিকে, জো বাইডেন বলেন, তাইওয়ানের বিষয়ে মার্কিন নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে স্থিতাবস্থা পরিবর্তন বা শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের যে কোনো একতরফা প্রচেষ্টার বিরোধী আমেরিকা।

তাইওয়ান উপত্যকায় চীনের আগ্রাসীভাব : তাইওয়ান উপত্যকা ঘিরে বেশ কয়েকটি চীনা প্লেন ওড়ার পাশাপাশি গত সোমবার থেকেই ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করছে বেশ কয়েকটি চীনা যুদ্ধজাহাজ। রয়টার্সের সূত্রটি বলেছে মঙ্গলবার সকালে চীনা যুদ্ধজাহাজ এবং বিমান উভয়ই মধ্যরেখাটিকে ‘চেপে ধরে’। এই অস্বাভাবিক পদক্ষেপকে ‘মারাত্মক উস্কানিমূলক’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ওই সূত্রটি জানিয়েছে, চীনের যুদ্ধবিমান বারবার কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে মধ্যরেখা স্পর্শ করে মঙ্গলবার সকালে চীনা ভূখøের দিকে ফিরে আসে। একই সময়ে কাছাকাছি এলাকায় তাইওয়ানের এলাকায় অপেক্ষায় ছিল। এছাড়া দুপুরের দিকে চীনের যুদ্ধবিমান ওই এলাকা ছেড়ে গেলেও জাহাজগুলো থেকে যায়। সাধারণত কোনও পক্ষই মধ্যরেখা পার করে না। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, তাইওয়ানের কাছাকাছি সামরিক কার্যকলাপ নিয়ে পূর্ণ ধারণা রয়েছে তাদের। এছাড়া ‘শত্রু হুমকির’ প্রতিক্রিয়ায় যথাযথভাবে বাহিনী প্রেরণ করা হবে বলে জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।

শি জিনপিং

প্রস্তুত আমেরিকার চার রণতরীও: চীনের কাছ থেকে অনবরত হুমকি-ধামকির মধ্যে পেলোসির তাইপে সফরকে কেন্দ্র করে তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে আমেরিকা। এর মধ্যে একটি বিমানবাহী রণতরীও আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্কিন নৌকমান্ডার জানান, “ই যুদ্ধজাহাজগুলো কোনওরকম ঘটনা ঘটলে তার জবাব দিতে সক্ষম। তবে তিনি বলেন, এই যুদ্ধজাহাজগুলো রুটিনমাফিকই মোতায়েন করা হয়েছে।
জাহাজগুলোর অবস্থান সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। তাছাড়া, উভচর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ত্রিপোলিও ওই এলাকায় আছে বলে জানান ওই কমান্ডার।

রাশিয়াকে পাশে পেল চীন : ন্যান্সি পেলোসির চলমান তাইওয়ান সফর এই অঞ্চলে অশান্তি উস্কে দিতে পারে বলে আমেরিকাকে সতর্কবার্তা দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন। মঙ্গলবার মস্কোতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি ও মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, তিনি (পেলোসি) তাইওয়ান সফরে যাবেন কিনা সে ব্যাপারে আমরা এখনও নিশ্চিত নই, তার এই সাম্প্রতিক এশিয়ায় আসা ও তাইওয়ানে সম্ভাব্য সফর সম্পূর্ণ উস্কানিমূলক এবং এ সফরের জেরে এশিয়ার এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা যে বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

‘আমেরিকাকে চরম মূল্য দিতে হবে’: পেলোসি যদি তাইওয়ানে সফর করেন তবে আমেরিকাকে মূল্য দিতে হবে বলে সতর্ক করেছে চীন। মঙ্গলবার বেইজিং আমেরিকাকে এমন হুঁশিয়ারি দেয়। মূলত চীন কোন ভাবেই চাচ্ছে না যে, পেলোসি তাইওয়ান সফর করেন। বেইজিং থেকে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং বলেন, চীনের সার্বভৌম নিরাপত্তা স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করার জন্য আমেরিকাকে মূল্য দিতে হবে। মার্কিন কর্মকর্তাদের তাইওয়ানে সফরের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পেলোসির মতো এমন হাই-প্রোফাইল কর্মকর্তা দেশটিতে সফর করেননি।

উত্তরদক্ষিণ । ০৩ আগস্ট ২০২২ । ১ম পৃষ্ঠা

সাড়ে চার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করছে তাইওয়ান: এদিকে, পেলোসি তাইওয়ান সফরে চীন সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে এমন হুমকিতে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে তাইওয়ান। বার্তা সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি মাথায় রেখে ভূগর্ভস্থ কার পার্কিং, পাতাল রেল ও ভূগর্ভস্থ বিপণীকেন্দ্রগুলোকে বাঙ্কারে পরিণত করেছে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ। দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী তাইপেইতে এ ধরণের ৪ হাজার ৬০০টিরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ হামলা শুরু হলে এসব বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে পারবেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, ১৯৪০ সালের গৃহযুদ্ধে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাইওয়ান। তারপর থেকে তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী রাজনীতিকরা নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম বলে দাবি করলেও চীন এই দ্বীপ ভূখøকে এখনও নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। ৩৬ হাজার ১৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপ ভূখণ্ডের রয়েছে নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃত্ব এবং প্রায় ৩ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্যের একটি সেনাবাহিনী।
এখন পর্যন্ত অবশ্য খুবই অল্প কয়েকটি দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকলেও তাইওয়ানে এখন পর্যন্ত নিজেদের কোনো দূতাবাস খোলেনি দেশটি।
তবে তাইওয়ান বিষয়ক একটি আইনের আওতায় এই স্বাধীনতাকামী দ্বীপভূখøকে গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সহায়তা দিয়ে আসছে আমেরিকা।

ইউডি/সুপ্ত

Md Enamul

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading