টেকসই উন্নয়নে শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি

টেকসই উন্নয়নে শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি
শ্রমিক নিরাপত্তা-দৈনিক উত্তরদক্ষিণ

সৈয়দ রিফাত । মঙ্গলবার, ২৪ মে ২০২২ । আপডেট ১০:১৭

একটি রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি সে রাষ্ট্রের শ্রমিকদের শ্রম। শ্রমিকের ঘামে ঘুরছে দেশ-বিদেশের উন্নয়নের চাকা। বিগত ৫১ বছরে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অর্থনীতির অন্যতম অংশীদার এদেশের শ্রমিকরাই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এদেশের কৃষক-শ্রমিক জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারাই নিজেদের শ্রম দিয়ে সচল রেখের অর্থনীতির চাকা। অথচ দুঃখজনকভাবে সেই শ্রমিকদেরই জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে সবচেয়ে কম। সামাজিকভাবে শ্রমিকরা এখনো অবহেলিত। সমাজে মালিক-শ্রমিক বিভাজন এখনো দৃশ্যমান। যাদের প্রতিনিয়ত পরিশ্রমে দেশ এগিয়ে চলেছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করা হয়, করা হয় বৈষম্যমূলক আচরণ। দেশের উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে তবে শ্রমিকদের প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখনো আসেনি।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের সঠিক মজুরি প্রাপ্তি ঘটে না। তাদের মজুরি বৃদ্ধির হার জাতীয় মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কম পারিশ্রমিকে কাজে নিযুক্ত করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরিসের (জিডব্লিউডি) সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, পোশাক শ্রমিকদের ওভারটাইমের আয় চলে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির পেটে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারায় শ্রমিকের সঠিক মজুরি এবং মজুরির ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমাধিকারের কথা বলা হলেও, তা প্রয়োগ হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমি মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করাচ্ছে অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ দক্ষ এবং স্বল্প দক্ষ শ্রমিক প্রবাসে যাচ্ছে এবং নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অর্থের সঠিক বিনিয়োগের অভাবে তাদের বেশির ভাগের অর্থই খরচ হয়ে যায় অলাভজনক খাতে। প্রবাসী শ্রমিকদের অর্থের নিরাপদ লগ্নির বিষয়েও বিকার নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা শ্রমিকের অন্যতম প্রধান অধিকার। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট আট অনুযায়ী, সবার জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি ও স্থিতিশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন আমাদের লক্ষ্য। তবে আমাদের দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি উদাসীন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য মতে, শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩ এবং নির্যাতিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৪৭ জনের, যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি, শিল্প কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার অভাব, প্রতিকূল পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করার পূর্ব ট্রেনিং না থাকা, ভবন ধস, সর্বোপরি নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের অন্যতম অন্তরায়। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্রাজেডির পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎপরতায় ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন করে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো যুগোপযোগী করা হলেও এখনো অনেক কলকারখানাগুলোতেই তা পুরোপুরিভাবে মানা হয় না। শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা কর্মের অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণবশত প্রায়ই কলকারখানাগুলোতে ছাঁটাই চলে। ফলে মুহূর্তে বেকার হয়ে পড়েন অনেক শ্রমিক। এছাড়া কর্মরত শ্রমিকদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা হওয়ার ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে। শ্রমিকদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিষ্ঠিত শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হলেও বিচারিক কার্যক্রম অত্যধিক সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সমাধানের চেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় বেশি।

শ্রমিকের কর্মের নিশ্চয়তার সঙ্গে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জড়িত। আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন। স্বল্পোন্নত থেকে বেরিয়ে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। ২০৩১ সালে আমরা উচ্চমধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবো। আগামীর টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিরাট অংশ জুড়েই প্রয়োজন হবে শ্রমিকদের। তাই শ্রমিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য এবং কর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৮২ লাখ। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো না গেলে উন্নত দেশের কাতারে নাম ওঠানো অনেকটাই অনিশ্চিত থেকে যাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমান সরকারের তৎপরতায় শ্রমিকদের উন্নয়নে নানামুখী কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে স্বচ্ছ তদারকিরও প্রয়োজন। শ্রমিক নেতৃত্বের নামে অশ্রমিক শ্রেণির কারণে যেন সরকার ঘোষিত উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যর্থ না হয় সে বিষয়েও সচেতন দৃষ্টি দিতে হবে। শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হলে একদিকে যেমন দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হবে, একই সঙ্গে তা ত্বরান্বিত করবে উন্নত বাংলাদেশের সম্ভাবনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউডি/সুস্মিত

Md Enamul

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading