করোনা সংক্রমণ: আবারও ঊর্ধ্বগতি

করোনা সংক্রমণ: আবারও ঊর্ধ্বগতি

উত্তরদক্ষিণ । শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২ । আপডেট ১৭:০৫

মহামারি করোনা মোকাবেলায় বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ। দেশে করোনার টিকাদান কার্যক্রমের অভাবনীয় সাফল্যে বাংলাদেশ পুরোপুরি করোনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশের সবকিছু আবারও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসাও শুরু করেছে। কিন্তু আচমকা গত এক সপ্তাহে করোনা শনাক্তের হার নতুন করে ভাবাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওমিক্রনের নতুন উপধরন। বিস্তারিত লিখেছেন মোঃ সাইফুল ইসলাম।

মহামারি করোনা সম্পূর্ণরূপে কবে নির্মূল হবে এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে। কেননা একেবারেই নিয়ন্ত্রণে আসা করোনা যে আবারও চোখ রাঙাচ্ছে। গত একসপ্তাহে দেশে করোনা শনাক্তের হার ৩৮৩ শতাংশ বেড়েছে। শনাক্তের হার ছাড়িয়েছে দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৪.৩২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা দিয়ে থাকলেও এমনকি বুস্টার দেয়া থাকলেও মাস্ক পড়তেই হবে। আর তাই এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ প্রবেশ করেছে। এমনকি এই ঢেউয়ে সংক্রমণ দ্রুত গতিতে চূড়ার দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেও ভূমিকা রাখার পরামর্শ তাদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ৬ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত (এক সপ্তাহ) আগের সপ্তাহের তুলনায় নতুন করে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১৮ দশমিক ১ শতাংশ। পরের সপ্তাহেই তা (১৩ থেকে ১৯ জুন) বাড়ে ৩৮৩ শতাংশ।

শঙ্কা বাড়াচ্ছে শনাক্ত হওয়া ওমিক্রনের নতুন উপধরন
দেশে দুইজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের নতুন সাবভ্যারিয়েন্ট ইঅ.৪/৫ শনাক্ত করেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি)। গত মঙ্গলবার (২১ জুন) যবিপ্রবি জিনোম সেন্টারের একদল গবেষক যশোরের দুইজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংগৃহীত ভাইরাসের আংশিক (স্পাইক প্রোটিন) জিনোম সিকুয়েন্সের মাধ্যমে করোনার নতুন এই উপধরনটি শনাক্ত করে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আব্দুর রশিদ এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান। এতে বলা হয়, আক্রান্ত দুইজন ব্যক্তিই পুরুষ। যাদের একজনের বয়স ৪৪ এবং আরেকজনের বয়স ৭৯ বছর। আক্রান্ত ব্যক্তির একজন করোনা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ এবং অপরজন দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং আরেকজন বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের শরীরে জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন মৃদু উপসর্গ রয়েছে। তারা উভয়েই স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে সক্ষম ওমিক্রনের উপধরন
এই উপধরনটি দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা সংক্রমণের পঞ্চম ঢেউ এবং সাম্প্রতিককালে ইন্ডিয়া করোনার তৃতীয় ঢেউ এর জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও এই সাবভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। আগামীতে এই সাবভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে সংক্রমণশীল অন্যান্য সাবভ্যারিয়েন্টের তুলনায় বেশি সংক্রমণ ঘটাতে পারে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। করোনার এই নতুন সাবভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের বিষয়ে যবিপ্রবির উপাচার্য ও জেনোম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সাবভ্যারিয়েন্টটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। এজন্য মাস্ক ব্যবহারসহ কঠোরভাবে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও জানান, অচীরেই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্স করে এ বিষয়ে আরও তথ্য জানা সম্ভব হবে এবং এই সাবভ্যারিয়েন্ট শনাক্তকরণের কাজ জিনোম সেন্টারে অব্যাহত থাকবে।

দেশে একদিনে শনাক্ত ছাড়াল ১৪.৩২ শতাংশ
দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৩১৯ জন। এই সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের। ফলে মোট মারা যাওয়ার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ১৩৫ জনে। আর মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জনে। শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১২৭ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ২৩২ জন। ২৪ ঘণ্টায় ৯ হাজার ২১৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ৯ হাজার ২১৪টি নমুনা। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

সারাদেশেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে যাবে
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘করোনা সংক্রমণ এখন সুস্পষ্টভাবেই নতুন ঘরে প্রবেশ করেছে। যদিও এখনও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে যায়নি। ঢাকা শহরেই মূলত সংক্রমণটা দেখছি। ধীরে ধীরে এটি এখন প্রায় প্রতিটা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে যাবে। আশঙ্কাজনক হলো, ওমিক্রনের মূল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে এটি আরও দ্রুতগতিতে ছড়ায়। আশঙ্কা করছি আমাদের দেশেও এমনটি হচ্ছে।’

মানুষ কী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে?
করোনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা ভুলতে বসেছে। দোকান-পাট, শপিং-মল সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনীহা থেকে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, মানুষ একদমই মাস্ক পরে না। করোনা শনাক্তের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক টেকনিক্যাল কমিটি যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তার মধ্যে আছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জনসাধারণকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের গণমাধ্যমে অনুরোধ জানাতে হবে। সব ক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম বর্জন করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান বাহন হলো শ্বাসনালি থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র জলকণা (ড্রপলেট), যা কথা বলা, গান গাওয়া, কাঁশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় বেরিয়ে আসে। যেসব জায়গায় কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব বেশি সেসব স্থানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে অন্যদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা সবসময় সম্ভব নয়, যে কারণে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবাইকে সুরক্ষিত থাকার জন্য কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম

‘মানুষকে টিকার আওতায় আনতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়ানক হতো’
নতুন করে করোনার সংক্রমণ নিয়ে সেভাবে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংক্রমণ যখন পাঁচ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে, আমরা বলতে পারি নতুন ঢেউয়ে প্রবেশ করেছি। তবে, খুব বেশি আতঙ্ক ছড়াবে বলে মনে হয় না। কারণ, আমাদের বিশাল সংখ্যক মানুষ টিকার আওতায় চলে এসেছেন। এছাড়া ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে অনেকের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যে কারণে সংক্রমণ ততটা বড় আকারে ছড়াবে না। যদি টিকা সেভাবে আমরা দিতে না পারতাম, তাহলে এই সময়ে অবস্থা খুবই ভয়াবহ হতো।’

উত্তরদক্ষিণ । ২৪ জুন ২০২২ । ১ম পৃষ্ঠা

টেকনিক্যাল কমিটির ৬ পরামর্শ
সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ছয়টি পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। পরামর্শগুলোর মধ্যে আছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জনসাধারণকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করতে সকল প্রকার গণমাধ্যমে অনুরোধ জানাতে হবে। সকল ক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম বর্জন করা প্রয়োজন। ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান (যেমন- মসজিদ, মন্দির, গির্জায় ইত্যাদি) মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দরকার।

যাদের জ্বর, সর্দি, কাশি হচ্ছে তারাও অনেকে কোভিড টেস্ট করেছেন না এতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। এ জন্য যাদের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে এবং যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে আসছেন তাদের টেস্ট করার জন্য অনুরোধ করতে হবে। যেসব দেশে কোভিড-১৯ জীবাণুর ভ্যারিয়েন্ট ও সাব ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের হার বেশি সে সকল দেশ থেকে আমাদের দেশে আগত আক্রান্ত মানুষের মাধ্যমে প্রবেশ করছে বলে মনে করা হয়। এ জন্য বিমান, স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ, টিকা সনদ আবশ্যক করতে হবে। বিশেষত অধিক আক্রান্ত দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ যারা এখনও নিতে পারেননি তাদের এটা নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করতে হবে। ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যাপারে নাইট্যাগ এর পরামর্শ অনুসরণ করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চতুর্থ ডোজ অনুমোদন করলে তা বিবেচনা করতে হবে। কোভিড-১৯ এর ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করার জন্য সম্ভাব্যতা বিবেচনা করা দরকার। ভ্যাকসিন পরবর্তী প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিন বজায় থাকছে যে সম্বন্ধে গবেষণা করা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে বিশেষ শয্যা, আইসিইউ ব্যবস্থা ও জনবল ছিল, তা বর্ধিত হারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা যেতে পারে।

ইউডি/সুস্মিত

Md Enamul

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading