উদ্বেগজনক পর্যায়ে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার

উদ্বেগজনক পর্যায়ে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার
পাচার_উত্তরদক্ষিণ

রেজাউল করিম খোকন । রবিবার, ০৩ জুলাই ২০২২ । আপডেট ০৯:৫০

দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আট হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচারের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপত্তার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুশাসন ইত্যাদি। এখনো দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। অনেকে নানা রকম দুর্নীতির মাধমে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করছে। এসব টাকা দেশের ব্যাংকে রাখলে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হতে পারে। এমন আশঙ্কায় দেশের বাইরে অর্থ পাঠিয়ে নিরপদ থাকতে চাইছেন তারা। সুইস ব্যাংকে গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখার কারণে সেখানকার ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অসৎ দুর্নীতিবাজ মানুষের উপার্জিত অবৈধ অর্থের জমা রাখার নিরাপদ জায়গা হিসেবে পরিচিত।

এদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ গত দুই দশক ধরে বেড়ে চললেও এসব অর্থ দেশে ফেরত আনা বা এসব অর্থের মালিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। এবারই বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে করছাড় বা করের ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে। অতীত অভিজ্ঞতা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যায়। আগে বাণিজ্যের আড়ালে বাণিজ্য পুঁজি পাচার হতো। এখন আর্থিক পুঁজি পাচার হচ্ছে। আর এ কাজের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতি চক্রের আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। পাশাপাশি সরকারি নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এ কারণে পাচারের অর্থ নামমাত্র করে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাজেটীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা চলে, দুর্নীতির আন্তর্জাতিকীকরণ চক্রের হাতে এখন নীতিও ছিনতাই হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এই টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। যার একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। এর বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে ব্যবসার নামে। দেশ থেকে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর কোনো পদ্ধতি না থাকার কারণে অবৈধ পথেই পাচার হচ্ছে টাকা। আর পাচার হওয়া এই টাকা রাখা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, আর এ কারণেই টাকা পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকেই এদেশে টাকা রাখতে নিরাপদ মনে করেন না। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দেশে রাখা কঠিন। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। টাকা কারা পাচার করছে, সবার আগে তা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। দেশের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে না। অথবা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই। সামগ্রিকভাবে কেন উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না, সেটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। আবার যদি এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে এটি বাড়তে থাকবে। এ অবস্থার উত্তরণে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার শুধু দেশের অর্থনীতিরই ক্ষতি করে না, দেশটির উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশে সেই অর্থপাচার আজ উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। বাংলাদেশেও মুদ্রাপাচার রোধে কিছু সংস্থা কাজ করছে বটে কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল সন্তোষজনক নয়।

লেখক- কলামিস্ট।

ইউডি/সুস্মিত

Md Enamul

Leave a Reply

Discover more from Daily Uttor Dokkhin

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading