বাজার সিন্ডিকেটের দাপট: চিনি এত তেতো!
উত্তরদক্ষিণ । সোমবার, ১৫ মে ২০২৩ । আপডেট ১৪:০০
নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে। একশ্রেণির সুবিধাভোগী অসাধু ব্যবসায়ী দাপট দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা সঞ্চার করছে। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে বাজারে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছে সরকার। এ নিয়ে আসাদ এফ রহমান’র প্রতিবেদন
চিনি নিয়ে কারসাজি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যেও আগুন
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা চিনির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। কয়েকদিন আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া খোলা চিনি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় চিনি বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এর পেছনে মজুদকরণের প্রভাব রয়েছে তা বলাই যায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম অনেকটাই বেড়েছে, তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। অথচ এক মাস আগেও তা ছিল ৫২০ মার্কিন ডলার। এরমধ্যে গত বুধবার পরিশোধিত খোলা চিনির দাম প্রতি কেজি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত পরিশোধিত চিনির দাম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দাম নির্ধারণের আগেই ২০-৩০ টাকা বেশি দামে চিনি বিক্রি করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।
সয়াবিন তেলের লিটারে ১২ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের লিটারে লিটারে ৯ টাকা বেড়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে দেশে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছিল সয়াবিন তেলের দাম। কিন্তু গত ৪ মাস ধরে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে কমানো হয়নি। বরং আরও বেড়েই চলেছে এই পণ্যটির দাম। প্রত্যাহারকৃত ভ্যাট চালু করায় গত বৃহস্পতিবার দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
রাজধানীর বাজারগুলোতে ৭৮০-৮০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। খুব কম দোকান বা বাজার রয়েছে যেখান ৬৫০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। এছাড়া ডিমের ডজন ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকায়। সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে। ৬০ টাকার নিচে কোন সবজি নেই। প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। এদিকে বাজারে সরবারহে ঘাটতির কারণেই আলু ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, বড় ব্যবসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করছেন। কোরবানির বাকি এখনও প্রায় ২ মাস। এরমধ্যেই অস্থির হতে শুরু করেছে মসলার দাম। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের মসলার দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এই অবস্থায় নিম্নবিত্ত তো বটে, মধ্যবিত্তের জীবনও হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। ক্রেতারা বলছেন, জনদুর্ভোগ লাঘবে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন এটাই প্রত্যাশা।
অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার কথা বললেন বাণিজ্যমন্ত্রী
দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশীয় কিছু কারণও কাজ করছে বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি অভিযোগ করেন, একশ্রেণির ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। রবিবার (১৪ মে) রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে এক কোটি পরিবার কার্ডধারীর কাছে চলতি মাসের পণ্য বিক্রি কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় বাণিজ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
টিপু মুনশি
টিপু মুনশি বলেন, বাজারে পণ্যের দাম যা বাড়ছে, তার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট আছে। কিছু ব্যবসায়ী সুযোগও নিচ্ছেন। তাদের সামাল দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে সরকার তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এটা সত্যি কথা, কোথাও কোথাও কেউ কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা ভোক্তা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। আমরা জানি, বাজারে কোথায় কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। টিসিবির চিনির দাম ১০ টাকা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা যে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করি, এর সবকিছুই আমদানিনির্ভর। গত ১৫ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম আবার বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করি, আন্তর্জাতিক বাজারের দাম যেন আমাদের বাজারে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়।
দ্রব্যমূল্য যেন পাগলা ঘোড়া, সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত
ঈদুল ফিতরের পর থেকে আবারও নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন নিত্যপণ্যের বাজারে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। লাগামহীন ভাবে মূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে খেটেখাওয়া মানুষের নাভিশ্বাসের উপক্রম। কয়েকদিনের ব্যবধানে তেল, চিনি, আলু ও পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কিছু পণ্য। হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী বেশ কিছু সবজির দামও। আর প্রতিবছর ঈদুল আজহায় মসলার দাম বাড়লেও এবার আগে থেকেই বাড়তি। কিছু পণ্যের দাম রমজান মাসের চেয়েও বেশি।
নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য জনগণকে যে কতটা অসহায় করে তুলেছে তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের সা¤প্রতিক এক বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে বলা যায়। তিনি বলেছিলেন, মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদছে, কারণ পকেটে টাকা নেই। আর এ অবস্থার একমাত্র কারণ হিসাবে তিনি বাজার সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করেন। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তার বক্তব্য যথাযথ বলেই প্রতীয়মান। কিছু লোক সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো মুনাফা লুটছে, অথচ এদের নিবৃত করার তেমন উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। এদের যথেচ্ছাচারে জনগণের জীবনমান নামছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থা সরকার কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ
দাম বাড়ালে আমদানির দিকে ঝুঁকবে সরকার, কৃষিসচিবের হুঁশিয়ারি
বাজারে দাম বাড়তে থাকলে সরকার শিগগির পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে পারে বলে জানিয়েছেন কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার। রবিবার (১৪ মে) সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত সভায় এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, উৎপাদন ও মজুদ বিবেচনায় দেশে এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই; অথচ বাজারে দাম কিছুটা বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের অভ্যন্তরে পেঁয়াজের বাজার সবসময় মনিটর করছে। দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকলে শিগগিরর পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
ওয়াহিদা আক্তার
কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও জানান ওয়াহিদা আখতার।এদিকে গত বৃহস্পতিবারও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছিলেন পেঁয়াজের দাম এখন যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ইন্ডিয়া থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ বাড়ানো হবে। মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যদি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে তাহলে আমদানি করা হবে।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
অসাধু ব্যবসায়ীরা খুবই দক্ষতার সাথে একের পর এক পণ্যে দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি একটাই-রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব। অথচ, তাদের দাবির সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যে বিস্তর ফারাকের চিত্র বারবারই উঠে আসে। বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছেও পরিষ্কার। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, সেটিই প্রশ্ন।
দৈনিক উত্তরদক্ষিণ । ১৫ মে ২০২৩ । প্রথম পৃষ্ঠা
বিশ্লেষকগণ বলছেন, বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাও বিবেচনার বিষয়। ব্যবসায়ী নেতারাই বলছেন, সব পণ্য দ্রব্যই মজুত আছে, নাটক চলছে কৃত্রিম সংকটের। বাজারের অব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম সংকট তৈরির নেপথ্যে কারা তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বিশ্লেষকদের মতে, সে ক্ষেত্রে সরকারকে প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সুশাসন, শক্তিশালী মনিটরিং সেল বা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ ও বাস্তবমুখী প্রয়োগ। এক পক্ষ অর্থের পাহাড় বানাবে, আরেক পক্ষের সংসারে চাল থাকবে না এমনটা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার কোনো পথই খোলা থাকবে না।
ইউডি/এজেএস