ম্যাজিক অব হোমিওপ্যাথি: মাতৃত্বের সাধ পূরণে হেলোনিয়াস

ম্যাজিক অব হোমিওপ্যাথি: মাতৃত্বের সাধ পূরণে হেলোনিয়াস
New born baby swaddled in a pink blanket with her mother

উত্তরদক্ষিণ । মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট ২০২০ । আপডেট: ১৬:৫০

ডা. ইশরাত হোসেন লিপটন: কোনো নারীর জীবনে সবচেয়ে বিধ্বংসী ও হৃদয় বিদারক ঘটনা অবশ্যই বার বার গর্ভপাত ঘটতে থাকা। এমনই এক ভগ্ন হৃদয়ের নারী নূসরত জাহান (৩২) চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি।

এখানে আসার আগে দীর্ঘদিন মাংশপেশীর প্রচণ্ড কামড়ানি জনিত সমস্যায় ভূগছিলেন নূসরত। এজন্য এলোপ্যাথিক ব্যাথানাশক ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাচ্ছিলেন তিনি। রোগের উপশম না হওয়ায় চট্টগ্রামের একজন প্রবীণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছে যান। নূসরতের জন্য রাসটক্স ব্যবস্থা দিয়েছিলেন ওই চিকিৎসক।

রাসটক্স নূসরতের সমস্যা সারাতে পারেনি। যাত্রাপথে ভালোই ছিলেন তিনি। সমস্যা বেড়ে যায় গন্তব্যে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টা পরে।

নূসরত আমার চেম্বারে আসেন ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। অস্থিরতা, সঞ্চালন ও চাপ প্রয়োগে উপশমসহ রসটক্সের সব লক্ষণই ছিল তাঁর মধ্যে। তারপরও রাসটক্স বিফল! বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম নূসরতকে।

২১ বছর বয়সে বিয়ে হয় নূসরতের। স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে থাকেন। তাঁর স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে কাজ করেন। বিয়ের পর প্রায় ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও মা হতে পারেননি নূসরত। তাঁর গর্ভসঞ্চার ঠিকই হচ্ছিল। কিন্তু ২০ সপ্তাহের আগে গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত চার বার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানালেন নূসরত।

নূসরত এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তাঁর জরায়ুর স্থানচ্যুতি জনিত সমস্যা আছে। (ইনট্রোভার্টেড ইউটেরাস)। তবে পরীক্ষার কাগজপত্র সঙ্গে আনেননি বলে দেখাতে পারেননি। নূসরত বললেন, ‘আমিও এটা বুঝি যে, আমার জরায়ুর সমস্যা আছে।’

ঋতুস্রাব সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে, আমাকে অবাক করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘মুখস্থ পড়া’ বলার মত গড়গড় করে বলে গেলেন— গত দেড় বছরে কবে কখন মাসিক হয়েছে এবং কোন বারে কতদিন স্থায়ী ছিল। এর মানে হল, নূসরত তাঁর জরায়ু ও ঋতুস্রাব সম্পর্কে অধিকতর সচেতন।

‘জরায়ু সম্পর্কে সচেতন’। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। অনেকটা ছোট্ট পরিসরের একটি ঔষধ নূসরতের জন্য যাচাই করতেই হল। হ্যাঁ, আমি হেলোনিয়াসের কথা বলছি। জরায়ু সম্পর্কে অধিক সচেতনতা হেলোনিয়াসের একটি সুনির্দিষ্ট শনাক্তকারী লক্ষণ।

হেলোনিয়াসে সিপিয়ার মত বিষন্নতা, মানসিক চাপ ও উদাসীনতা আছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, হেলোনিয়াসে শারীরিক দুর্বলতা আর মানসিক চাপের পর্যায়ক্রমিক একটা অবস্থা রয়েছে। সিপিয়ার মত চিৎকার বা চেচামেচি করেন না হেলোনিয়াস। আবার সিপিয়া নিঃসঙ্গ থাকতে চান। পক্ষান্তরে হেলোনিয়াস নিজের মানসিক বিষন্নতা কাটানোর জন্য পরিচিতজনদের সঙ্গ চান, বাইরে ঘুরতে চান, শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটা করতে চান। আর এসব করে তিনি স্বস্তিও পান।
কিন্তু যখনই তিনি ঘরে ফিরে আসেন, ঠিক তার পরক্ষণেই শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে আকড়ে ধরে।

সিপিয়ার উপযোগিতা সাধারণত শুরু হয় সুন্দর একটি সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার মধ্য দিয়ে, কোনো নারীর প্রথম সন্তানটি জন্মের পরপরই। আর হেলোনিয়াসের উপযোগিতা দেখা দেয় একজন নারীর একাধিক বার গর্ভপাতের কারণে বিধ্বস্ত হওয়া বা হৃদয় ভগ্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৩০ বছর বয়সের আগে হেলোনিয়াসের উপযোগিতা পাওয়া যায় না।

হেলোনিয়াস উপযুক্ত ক্ষেত্রে বারবার গর্ভপাতের প্রবণতা সারিয়ে তুলতে সক্ষম। গর্ভপাত জনিত বিধ্বস্ত, ভগ্ন হৃদয়ের নারীর মাতৃত্বের সাধ ও স্বপ্ন পূরণের সহায়ক।

হেলোনিয়াসে শরীরের মাংসপেশীগুলোর মধ্যে কামড়ানি ব্যথা আছে। ব্যথায়, কামড়ানিতে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। পেশীর এই কামড়ানির সঙ্গে পুরো অবস্থাই রাসটক্স সদৃশ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু হেলোনিয়াস ছড়া এ ক্ষেত্রে সুফল আসবে না।

গতকালই ঢাকার ডা. সালমা নাসরিন Salma Nasreen বলেছিলেন, তাঁর একজন রোগীর সব লক্ষণ হুবহু বেলেডোনার ছিল। কিন্তু বেলেডোনা তাঁকে পুরোপুরি হতাশ করে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এগুলো হল ঔষধের ‘ছদ্মবেশী লক্ষণ’। (ছদ্মবেশী লক্ষণ বলতে স্বীকৃত কিছু নেই। এটি আমার নিজস্ব মত)। সব লক্ষণ মিলে যাওয়ার পরও ঔষধটি কার্যকর না হওয়া মানে, প্রাপ্ত লক্ষণ সমষ্টির আড়ালে ভিন্ন কোনো ঔষধের প্রতিমূর্তি লুকিয়ে থাকা।
নূসরতের ক্ষেত্রেও রাসটক্সের আড়ালে হেলোনিয়াসের প্রতিমূর্তি ছিল।

নূসরতেরও বিষন্নতা ছিল, ছিল শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ক্রমিক অবস্থা। তিনি বললেন, ‘মন খারাপ হলে আমি ফোনে আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। যতক্ষণ কথা বলি, ততক্ষণ বেশ ভালোই থাকি। কথা শেষ করার কিছুক্ষণ পরই শরীরের মাংসের মধ্যে কামড়ানি শুরু হয়।’
এ লক্ষণটি কোনো গ্রন্থে নেই। কিন্তু ফোনে কথা বলাও তো এক ধরণের সঙ্গ দেওয়ার মধ্যেই পড়ে!

নুসরতের জন্য আমি হেলোনিয়াস ব্যবস্থা দিয়েছিলাম। এম/২, এম/৩, এম/৪।
ঔষধ শুরুর পরদিনই নূসরত চেম্বারে এসে জানিয়ে গেলেন, তাঁর পেশীর ব্যথা আর টের পাচ্ছেন না।

এক মাস পর নূসরত জানালেন, পেশীর ব্যথা আর হয়নি। তিনি মনে করছেন, তাঁর জরায়ুর অস্বাভাবিকতাও অনেকটা সেরে উঠছে। তিনি চট্টগ্রাম চলে যাবেন। তাই আরও কিছুদিনের ঔষধ নিয়ে যেতে চাচ্ছেন।

নূসরতকে হেলোনিয়াস এম/৫ থেকে এম/১৪ পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হল। এরপর আর নূসরত কোনো যোগাযোগ করেননি।

২০১৯ সালের জুন মাসে নূসরতের স্বামী ফোন করে জানিয়েছেন, নূসরত কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে নির্ধারিত সময়ের দুই সপ্তাহ আগেই সিজার করা হয়েছে। মা-মেয়ে দুজনই সুস্থ আছেন। (ছবি: প্রতীকী)

লেখক: হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, ডিএইচএমএস (বিএইচবি) ঢাকা