ঘরের ভেতরে করোনার সংক্রমণ এড়াতে যা করবেন

ঘরের ভেতরে করোনার সংক্রমণ এড়াতে যা করবেন

উত্তরদক্ষিণ । শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০ । আপডেট: ১৮:২০

বদ্ধ ঘরের ভেতর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজন ভালো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। অনেক দেশেই ঠাণ্ডার সময় এগিয়ে আসছে, যখন ঘর গরম রাখতে দরোজা জানালা বন্ধ রাখতেই মানুষ বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এর মধ্যেও করোনার সংক্রমণ এড়াতে বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা রাখাটা খুবই জরুরি। গত কয়েকমাস বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে এসেছেন করোনাভাইরাস ঠেকাতে হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর। এখন বিজ্ঞানীরা এবং সেইসাথে প্রকৌশলীরা বলছেন- যে বাতাসে আমরা নি:শ্বাস নিচ্ছি সেই বাতাস নিয়েও চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। বিশেষ করে লকডাউন শিথিল হবার পর বেশিরভাগ জায়গায় মানুষের যাতায়াত আবার শুরু হয়েছে। অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, দোকান রেস্তোরাঁগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করছে। এ নিয়ে বিবিসি বিজ্ঞান সম্পাদক ডেভিড শুকম্যানের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিচে তুলে ধরা হলো-

ভালো বাতাস চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয়
১. ঘরের বাতাস গুমোট মনে হলে, বেরিয়ে যান: কোন ঘরের ভেতরে ঢুকে যদি মনে হয় সেখানকার বাতাস গুমোট, বাসি, তাহলে ধরে নেবেন সেই ঘরে বাতাস চলাচল করে না। কোন ঘরে যদি বাইরের মুক্ত বাতাস না খেলে, তাহলে আপনার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হবার ঝুঁকি বাড়বে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বদ্ধ ঘরে ভাইরাস থেকে ”বায়ুবাহিত সংক্রমণের” আশংকা রয়েছে। এমনকী যদি ভাইরাসের সূক্ষ্ম কণাও বাতাসে থেকে থাকে। মহামারির আগেও ব্রিটেনে কর্মক্ষেত্রে বাতাস চলাচল বিষয়ে সরকারি নির্দেশিকায় বলা ছিল কর্মস্থলে এমন ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক যাতে প্রত্যেক কর্মী প্রতি সেকেণ্ডে ১০ লিটার পরিষ্কার বাতাস পায়। মহামারি পরিস্থতিতে এটা মেনে চলা এখন খুবই জরুরি। কাজেই, কোন ঘর যদি বদ্ধ মনে হয়, সেখানে খোলা হাওয়ার অভাব মনে হয়, সেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন, বলছেন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. হাইওয়েল ডেভিস। তিনি বলছেন পরিষ্কার বাতাসের সরবরাহ রাখা নিতান্তই আবশ্যক।

২. এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা চেক করুন: অফিস থেকে শুরু করে দোকান সব জায়গায় এখন এয়ার কন্ডিশনিং-য়ের ব্যবস্থা রয়েছে। গরমের দিনে সেটাকে মানুষ স্বাগতই জানায়। কিন্তু দেখে নিন কী ধরনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় দেয়াল বা ছাদে লাগানো স্প্লিট মডেলের এয়ার কন্ডিশনার। এধরনের এয়ার কন্ডিশনার ঘর থেকে বাতাস টেনে নেয়, সেটাকে ঠাণ্ডা করে এবং সেই বাতাস আবার ঘরের মধ্যে ছাড়ে।

অর্থাৎ এধরনের এয়ার কন্ডিশনার বাতাস পুর্নসঞ্চালন করে। এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে এমন ঘরে অল্প ক্ষণের জন্য থাকলে আশংকার কারণ নেই। তবে দীর্ঘক্ষণ কাটাতে হলে যেহেতু ঝুঁকি রয়েছে। তাই কী ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে তা দেখে নেয়া ভালো।

চীনে এক রেস্তোরাঁর ওপর চালানো একটি গবেষণায় ভাইরাস ছড়ানোর জন্য এধরনের এয়ার কন্ডিশনিং যন্ত্রকে দোষারোপ করা হয়েছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে রেস্তোরাঁয় আসা একজনের শরীরে ভাইরাস ছিল, তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, কারণ তখনও তার উপসর্গ দেখা দেয়নি।

৩. বাইরের বাতাস কতটা অনুপাতে থাকা উচিত: অনেক আধুনিক ভবনে জানালাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকে, জানালা খোলার ব্যবস্থাই থাকে না। তাহলে সেসব ক্ষেত্রে বাইরের বাতাস ঢুকবে কেমন করে? সেক্ষেত্রে আপনাকে নির্ভর করতে হবে এমন ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার ওপর, যার মাধ্যমে ঘরের দূষিত বা বদ্ধ বাতাস বাইরে বের করে আনা হবে এবং সেই বাতাস পাইপের মাধ্যমে বাইরে একটি বাতাস সঞ্চালন ইউনিটে গিয়ে জমা হবে। সাধারণত এই ইউনিট থাকে এধরনের ভবনের ছাদে।

এই ইউনিট বাইরে থেকে পরিষ্কার বাতাস টেনে নেয় এবং ভেতরের বাসি বাতাসের সঙ্গে তা মিশিয়ে দেয় এবং তারপর ওই মিশ্রিত বাতাস আবার ঘরে ফেরত পাঠায়। ঘরের ভেতরের বাতাস থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার যে ঝুঁকি রয়েছে সেটার পটভূমিতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন বাইরের পরিষ্কার বাতাস যেন ঘরে যথেষ্ট পরিমাণে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে।

৪. ফিল্টারে ভাইরাস আছে কি না সেটার পরীক্ষাও ফলদায়ক: আধুনিক ভেন্টিলেশন ব্যবস্থায় সাধারণত ফিল্টার থাকে, কিন্তু সবসময় সেসব ফিল্টার ঠিকমত কাজ করে কি না সে ব্যাপারে সংশয় আছে। আমেরিকায় অরিগান হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে অনুসন্ধান চালিয়ে গবেষকরা দেখেছেন যে সেখানে ভেন্টিলেশন বা বাতাস চলাচল ব্যবস্থার ফিল্টার কিছু করোনার জীবাণু আটকে দিলেও কিছু ভাইরাস কীভাবে সেই ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে গলে গেছে।

ওই প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক কেভিন ভ্যান ডেন ওয়াইমেলেনবার্গ মনে করছেন এধরনের ফিল্টার থেকে সোয়াব বা নমুনা সংগ্রহ করলে জানা যেতে পারে ওই ভবনে কাজ করে বা থাকে এমন কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছে কি না। দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি অফিস ভবনের ১১ তলার একটি কল সেন্টারে এক ব্যক্তি ৯০ জনের বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে। ফিল্টার নিয়মিত পরীক্ষা করলে ভাইরাসের উপস্থিতি দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব।

৫. বাতাসের প্রবাহের দিকে নজর রাখুন: এ বিষয়ে যেকোনও বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করলে বলবেন পরিষ্কার বাইরের বাতাস সঞ্চালন সংক্রমণ ঠেকানোর গুরুত্বপূর্ণ একটা হাতিয়ার। কিন্তু বাতাস চলাচলের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন ব্যাপার অত সহজ নয়।

নিক ওয়ার্থ ফরমুলা ওয়ান মোটর দৌড়ের গাড়ি ডিজাইন করতেন। এখন তিনি সুপারমার্কেট এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজত কোম্পানির কর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপদ রাখার জন্য বাতাস সঞ্চালন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালনার কাজ করেন। তিনি বলছেন একজন কর্মী যদি খোলা জানালার পাশে বসে কাজ করেন এবং তিনি যদি সংক্রমিত হয়ে থাকেন, তাহলে তার শরীরের ভাইরাস জানালা দিয়ে বাতাসের কারণে নিচের দিকে যাবে। ”আপনি যদি জানালা খোলেন, বাতাস কোথায় যাবে? খোলা জানালা দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হবে সামনে এবং যারা বাইরে বাতাসের লাইনে থাকবে, তারাই ওই ভাইরাসের লক্ষ্যবস্তু হবে,” তিনি বলছেন।

যদি ঘরটি উপরের তলায় হয়, বাতাস সোজাসুজি প্রবাহিত হয়ে কিছুটা নিচের দিকে নামবে। ”প্রচুর বাইরের বাতাস আসা ভাল। কিন্তু সেটা যদি সোজাসুজি প্রবাহিত হয় এবং তা ভাইরাসে পূর্ণ থাকে তাহলে তার পরিণাম বাইরের লোকেদের জন্য অভিপ্রেত হবে না।”

এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক ক্যাথ নোকস বলেন, তার মতে অনেক পরিমাণ পরিষ্কার বাইরের বাতাস ভাইরাসের সাথে মিশলে ভাইরাসের পরিমাণ কমে যাবে এবং ঝুঁকিও কমবে। তিনি বলেন খোলা জানালার বাইরে ভাইরাস পূর্ণ বাতাসের গতিপথে কেউ থাকলেও তাদের নি:শ্বাসের সাথে যে পরিমাণ ভাইরাস ঢুকবে তা পরিমাণে কম এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত তো আছেই। এতে অবাক হবার কিছু নেই। আর এই ভাইরাস নিয়ে অনেক কিছু এখনও মানুষের অজানা। তবে যে বাতাসে আমরা নি:শ্বাস নিচ্ছি তা কতটা ভাইরাস মুক্ত বা ভাইরাস পূর্ণ সেটা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।